গল্প- আদর্শ

আদর্শ
– সঞ্চিতা রায় (ঝুমকোলতা)

 

আজ ছোট্ট রাইমাকে নার্সিংহোম থেকে বাড়িতে নিয়ে যাবে তার বাবা মা। এই কয়েকদিন যমে মানুষে টানাটানি হয়েছিল ওকে নিয়ে। ডাক্তার আদর্শ সেনের তত্বাবধানে একটা অপারেশান হয়েছে। বেশ বড় অপারেশান। ওইটুকু মেয়ের পক্ষে বেশ ভয়েরই ছিল। অপারেশন সফল। জয়ীর হাসি ডাক্তার আদর্শের মুখে। একজন চিকিৎসক যখন মানুষকে নতুন জীবন দেন, তাঁর মনে যে অপূর্ব অনুভূতি হয়, সেই অপূর্ব অনুভূতিতে আদর্শ র মন ভরে যাচ্ছে। সত্যি কথা বলতে বাচ্চাটির ওষুধ, অন্যান্য দরকারী জিনিস অনেকটাই আদর্শ সেনকে কিনে দিতে হয়েছে। কারণ রাইমাদের আর্থিক অবস্থা খুবই সাধারণ। অবশ্য ‘মানবিক’ নামক এই নার্সিংহোমের এইটাই রীতি । যতটা কম খরচে রোগীর চিকিৎসা করা যায়,ততটা কম খরচেই চিকিৎসা করা হয়।
আদর্শ সেন একজন বিখ্যাত চিকিৎসক। সবাই তাঁকে ধন্বন্তরি বলে। তাঁর চেম্বারে সব সময় রোগীদের ভীড়। তাঁর সাম্মানিক বা পারিশ্রমিক অত্যন্ত কম। করোনার সময় ও তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। তিনি একজন সমাজসেবক। অভাবী মেধাবীদের জন্য তিনি একটি সংস্থা গড়ে তুলেছেন। মেধাবীই বা বলি কেন সব রকম মেধার মানুষকেই তিনি জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেন। যার যা প্রতিভা আছে তিনি সেই প্রতিভা বিকশিত হতে সাহায্য করেন। ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধিরা তাঁর কাছে এলে তিনি তাদের কথা শোনেন ঠিকই, কিন্তু তাদের থেকে কোনো রকম উপহার গ্রহণ করেন না। রোগীর প্রয়োজন অনুয়ায়ী একদম কম দামের ওষুধ তিনি ব্যবস্থা পত্রে লেখেন। এ ক্ষেত্রে তিনি কোনো রকম ওষুধ কোম্পানির প্রতিনিধি দ্বারা প্রভাবিত হন না। তাঁদের কথা তিনি শোনেন শুধুমাত্র জ্ঞান বৃদ্ধি বা বাজারে রোগীর জন্য উপকারী কি ওষুধ আছে, কি কি নতুন ওষুধ এল শুধুমাত্র সেইটুকু জানার জন্য। একবার তিনি অতি সামান্য ভিসিট বাড়ানোর কথা ভেবেছিলেন, তাঁর মা তাঁকে বলেন,জীবিকার প্রয়োজনে, জীবনের ন্যুনতম চাহিদা পূরণের জন্য তোর যা দরকার সেইটুকুই ব্যাস,তার বেশী বাড়াবি না, তুই মানুষের ডাক্তার মানবিকতার প্রতিভূ। না,ভিসিট বাড়ানো হয়নি তার। – ডাক্তারবাবু আমাদের কাগজের জন্য একটা সক্ষাৎকার চাই যদি একটু সময় দেন।
– আমার রোগী দেখার পরে আসুন।

-শুভ দুপুর ডাক্তারবাবু
-শুভ দুপুর
– অভিনন্দন ডাক্তার বাবু, আদর্শ চিকিৎসক হিসাবে সরকার আপনাকে পুরস্কৃত করতে চলেছে। – ধন্যবাদ
– এটা কি ঠিক, আপনি খুব অল্প দামী ওষুধ দেন আর তাতেই আপনার রোগীরা সুস্থ হয়ে যায়।
– চেষ্টা করি
– আপনার মনে হয় না এতে ওষুধ কোম্পানিগুলোর লোকসান হতে পারে?
– একজন চিকিৎসক হিসাবে আমার তো মানুষের কথা ভাবার কথা, রোগীদের ভালো করার কথা ভাবার কথা, তাদের সামর্থের কথা ভাবার কথা, কোনো কোম্পানির সুবিদার্থের কাজ করার কথা তো নয়।
– তাহলে বাজারে একই কম্পোজিশনে একই রকম কর্যকরী কম দামী ও বেশীদামী দুইরকমই ওষুধ থাকে, এই কথা কি ঠিক?
– আমি এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। রোগীকে সুস্থ করার জন্য আমার যা করণীয় আমি তাই করি এবং তাই করবো।
– আচ্ছা ডাক্তারবাবু আপনার মেয়ে ইতিহাস নিয়ে পড়ছে, আপনার মনে হয় না বিজ্ঞান শাখায় পড়লে জীবনে উন্নতি করতে পারতো, হয়তো বা ডাক্তার হতে পারতো।
– না আমি তা মনে করিনা, আমি মনে করি প্রতিটি মানুষের সেই কাজই করা উচিৎ,যা সে ভালোবেসে করতে পারবে, ছোট থেকে ইতিহাসের প্রতি ওর অগাধ ভালোবাসা। আমি মনে করি, ইতিহাস নিয়ে কাজ করেই ও জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে।
– তাহলে আপনার একমাত্র সন্তান ডাক্তার হল না বলে আপনার কোনো আপসোস নেই, যেখানে আপনি ও আপনার স্ত্রী দুজনেই ডাক্তার।
– একেবারেই না, আর ও যদি ডাক্তারিতে আগ্রহীও হত, তাহলেও ওর যোগ্যতা থাকলে তবেই আমি পড়াতাম । ডোনেশান দিয়ে কখনই পড়াতাম না। আমি যোগ্যতায় বিশ্বাসী। ওর যোগ্যতা অনুযায়ী ও কাজ ঠিক খুঁজে নেবে।
– আপনাকে সরকার একজন আদর্শ ডাক্তার হিসাবে পুরস্কৃত করতে চলেছে, আপনি খুশি? -পুরস্কারের জন্য তো কিছু করি না, মানুষ হিসাবে যা করণীয় তাই করি, তবে হ্যাঁ পুরস্কার মূল্যের ওই টাকাটা আমি মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করবো।

-পরীক্ষা করানোর ব্যাপারে আপনার মতামত?
– প্রয়োজন হলে করাব, কিন্তু অকারণে নয়। সবাই বলে আপনার ক্লিনিকাল আই ভীষণ ভালো, অপ্রয়োজনে পরীক্ষা করান না। মৃদু হাসি, কোনো মন্তব্য নেই।
-আপনি কি কোনো চিকিৎসক দ্বারা অনুপ্রাণিত?
– বলতে পারেন বোলপুরের একজন ডাক্তার, যাকে মানুষ ‘একটাকার ডাক্তার’ বলতেন তাঁর দ্বারা। তাছাড়া শ্যামনগরের একজন ডাক্তার, যিনি করোনায় চলে গেলেন, আপনারা নিশ্চয় সংবাদে মানুষের তাঁর প্রতি ভালোবাসা দেখেছেন। ওই করোনাকালেও তার শেষযাত্রায় মানুষের চোখের জল নিয়ে নীরবে তার সাথে সাথে চলেছিল। বাড়িগুলো থেকে ফুল বর্ষণ হচ্ছিল । এছাড়াও আরো অনেক ডাক্তার আজও আছেন, যারা মানুষের জন্য নিঃস্বার্থ ভাবে কাজ করেন, ডাক্তারীর স্বীকৃতি র সময় নেওয়া পণের মান রাখতে পারেন, বয়স নির্বিশেষে তারাই আমার আদর্শ।
– আপনি কি মনে করেন এখনও এইরকম ভালো ডাক্তার অনেক আছেন?
– নিশ্চয়, এই তো আজকের খবরের কাগজেই দেখলাম ,ট্রাফিক জ্যামে আটকে যাওয়া একজন ডাক্তার সঠিক সময়ে অপারেশন থিয়েটারে পৌঁছাবার জন্য গাড়ি থেকে নেমে ছুটে নার্সিং হোমে পৌঁছেছেন। কদিন আগে দেখলাম একজন ডাক্তার নিজে রক্ত দিয়ে একজন প্রসূতিকে বাঁচিয়েছেন। আমার প্রিয় লেখক বনফুল, যিনি নিজেও ডাক্তর ছিলেন। তাঁর সৃষ্ট চরিত্র ‘অগ্নিশ্বর’-রা বাস্তবেও আছেন।
– যারা ডাক্তার হতে চলেছে তাদের প্রতি আপনার বার্তা!
– মানুষ হয়ে মানুষের পাশে দাঁড়াক, সাম্মানিক বা পারিশ্রমিকটা মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখুক,অনেক মানুষ শুধু অর্থের কারণে আজও ওঝা, ঝাড়ফুঁক, হাতুরড়দের কাছে যেতে বাধ্য হয়, তাদের কথা ভাবুক। চিকিৎসা ব্যবস্থাকে মানুষের সাধ্যের মধ্যে রাখার চেষ্টা করুক। সৎ ভাবে কাজ করুক।

– সম্প্রতি আপনার মেয়েকে বোধ হয় লোভনীয় কিছু উপহার দিতে চেয়েছিল কোনো কোম্পানি, আপনার মেয়ে প্রত্যাখান করেছে একথা কি সত্যি?
– হ্যাঁ আমি গর্বিত, ওকে আমি ছোট থেকেই শিখিয়েছিলাম স্বার্থসিদ্ধির জন্য কেউ কিছু দিতে গেলে সেটা গ্রহণ না করতে, ও আমার মান রেখেছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি। তা সে যেভাবেই হোক। রক্ত বা জিন সত্যিই বোধ হয় কথা বলে। উচ্চ মাধ্যমিকে মেধা তালিকায় আছে আদর্শ সেন। ডাক্তারির জয়েন্টে এন্ট্রাস পরীক্ষাতেও প্রথম পাঁচজনের মধ্যে। কিন্তু চরম দারিদ্র্য তাদের পরিবারের। কিভাবে পড়াবে মুকুল সেন ছেলেকে ডাক্তারি! পুরো পরিবার চিন্তায়। এতদিন তো স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা খুব সাহায্য করেছেন তাকে। বাড়িতে এসে পর্যন্ত পড়া দেখিয়ে দিয়ে গিয়েছেন। না কোনো গৃহশিক্ষক বা গৃহশিক্ষিকা তার ছিল না। কোনো নামী কোচিং সেন্টারেও তার পক্ষে পড়া সম্ভব হয়নি। সম্পূর্ণ নিজের ক্ষমতায় সে আজ সফল। বাতাস কোচিং সেন্টার থেকে তাকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তাকে শুধু বলতে হবে, যে সে বাতাস কোচিং এ পড়ে সফল, অনেক অনেক টাকা ডাক্তারী র বই সব দেবে তারা। মানিনি প্রকাশনা সংস্থা থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে,তাকে শুধু বলতে হবে তাদের বই পড়েই তার এই সাফল্য। বাড়ি সারিয়ে দেবে। ডাক্তারী পড়ায় আর্থিক ভাবে সাহায্য করবে। আত্মীয়দের অনেকে, পাড়া প্রতিবেশীদের অনেকেই এই প্রস্তাব গ্রহণ করতে বলছে। তা নাহলে পড়বে কি করে। ছাদ ফেটে গেছে। জল পড়ছে মাথায়। দেওয়ালের জীর্ণ দশা। সামনে বিরাট অনিশ্চয়তা। কি করবে আদর্শ? বাবা মা তোমরা কি বলো?
– তোর নাম আদর্শ রেখেছিলাম,অনেক আশা নিয়ে, জানি আমি তোকে হয়তো পড়াতে পারবো না, তবুও বলি অনেক আশায় তোর নাম আদর্শ রেখেছিলাম, বাবা বললেন। বাবার ইঙ্গিতবাহী কথা বুঝতে আদর্শর কোনো অসুবিধা হয় নি সেদিন। আর সত্যি তো সে নিজেও সততা ও সত্যের আদর্শে বিশ্বাসী । পরের দিন বাড়িতে আসা সাংবাদিকদের সে দৃঢ় কণ্ঠে জানিয়ে দিল,বাবা,মা আর স্কুলের শিক্ষক শিক্ষিকারা তাকে সাহায্য করেছে, আর যে বইগুলো সে সত্যি করে পড়েছে, সেই বই গুলোর নাম বললো। আরো বললো পাঠ্যবই খুঁটিয়ে পড়া তাকে স্কুল শিক্ষক শিক্ষিকারাই শিখিয়েছে। আর স্পষ্ট জানিয়ে দিল কোনো কোচিং সেন্টারের সাহায্য সে নেয়নি। হ্যাঁ, সেদিন তার শুরুটা খুব কঠিন হয়েছিল, অনেক প্রতিকূল অবস্থার সাথে লড়াই করে আজ তিনি সফল ডাক্তার। সেদিন যে আদর্শকে তিনি জীবনের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, আজও সেই আদর্শ তাঁর সাথে আছে। থাকবে চিরকাল। হ্যাঁ বাবার মায়ের দেওয়া আদর্শ নাম সার্থক ।
( সঞ্চিতার ছোট্ট বক্তব্য- এই গল্পে ব্যবহৃত চরিত্রের নাম বা সংস্থার নাম সম্পূর্ণ কাল্পনিক । বাস্তবের সংস্থা বা চরিত্রর নামের সাথে মিল থাকলে তা অনিচ্ছাকৃত। তবে এই রকম আদর্শরা, এই রকম ভালো চিকিৎসকরা আছেন, ছিলেন ,থাকবেন আমাদের সমাজে। আর হ্যাঁ আদর্শের আদর্শ হিসাবে যে চিকিৎসকদের কথা বলা হয়েছে, তাঁরা প্রকৃতই আছেন বা ছিলেন। আর সে জন্যই সমাজটা পৃথিবীটা আজও এত সুন্দর।)

Loading

Leave A Comment